মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা রচনা

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা

ভূমিকা:

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান দূর করে অজ্ঞান,
শিক্ষা পণ্য করি ভরে তোলে মন প্রাণ।

বিজ্ঞান মানব সভ্যতার উত্তরণের সিঁড়ি। আদিম মানুষের নৈসর্গিক বিস্ময়ে যেদিন যুক্তি, বিচার ,বিশ্লেষণের পথ ধরে বিশ্লেষিত হয়েছিল, সেই দিনই বিজ্ঞানের শুভ সূচনা ঘটেছিল। তারপর বহু যুগ ধরে মানুষ গড়ে তুলেছে তার বিজ্ঞান সাধনা, সৌধ ও বিজ্ঞান বিদ্যা সম্ভার। তখন মানুষ অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জগতের রহস্য, বোঝার চেষ্টা করত। এখন সে বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ চর্চা করে রহস্য সন্ধান করে। তাই বিজ্ঞান বিদ্যাচর্চা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা শিক্ষার বিষয়।

মাতৃভাষা ও শিক্ষা:

শিক্ষার সাথে মাতৃভাষা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। সব শিক্ষাবিদই মনে করেন, মাতৃভাষা শিক্ষার অন্যতম বাহন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ J.R Firth মন্তব্য করেছেন, “As a first principle, fix your faith to the mother tongue.”
রবীন্দ্রনাথ তার সক্রিয় ভঙ্গিতে বলে গেছেন, শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। UNESCO সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে, “The best medium for teaching is the mother tongue of the pupil.”

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ক্রমোন্নতি এবং মাতৃভাষার গুরুত্ব:

প্রথাগত ভাবে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ইংরেজদের হাত ধরে। সম্ভবত ইংরেজি ভাষাতে আমাদের দেশের বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলার রেনেসাঁস যুগের মনীষী এবং বিজ্ঞানীরা জাতীয়তাবোধ উন্মেষের মুহূর্তে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন, বিজ্ঞানের নানা বিষয় যথা রসায়ন, শরীরতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত তথ্য প্রথম প্রকাশ পায় বিদ্যাদর্শন পত্রিকাতে। পরবর্তীকালে শিক্ষার সাথে বিজ্ঞানচর্চাতেও মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বাংলায় বিজ্ঞানধর্মী রচনাপ্রকাশ করেন। তার রচিত অব্যক্ত বিজ্ঞান রচনা এবং সাহিত্য চেতনার যুগলবন্দী। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে শান্তিনিকেতন থেকে বিজ্ঞান পুস্তিকা প্রকাশ করতে থাকেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, জগদানন্দ রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখরা। বিশ্ব বিখ্যাত পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন, যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান জানেন না।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যৌক্তিকতা:

বিশেষ কোন ভাষা বিজ্ঞানচর্চার শর্ত নয়। নাগার্জুন, মাদাম কুরি যথাক্রমে গ্রীক, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি তাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেছেন। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষার ব্যবহার শিখতে যে শিখন সময় ব্যয় হয়, মাতৃভাষায় যিনি বিজ্ঞানচর্চা করেছেন তিনি সেই সময়টি বিজ্ঞানচর্চার কাজে ব্যয় করতে পারেন।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা:

আমাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কিছু আপাত সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথম অসুবিধা হল উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক এর অভাব এবং পরিভাষার জটিলতা। বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ত করে তুলতে হলে এগুলির ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।

বর্তমান বিশ্বায়ন এবং বিজ্ঞান চর্চা:

বর্তমানে পৃথিবীর বিজ্ঞান চর্চা হয়ে উঠেছে যন্ত্রনির্ভর। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আজকের বিজ্ঞান চর্চার অপরিহার্য শর্ত। কম্পিউটারের ভাষা মূলত ইংরেজি কেন্দ্রিক। তাই এই পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ইংরেজি ভাষাকে আমরা বিজ্ঞানচর্চার ভাষা হিসাবে আমরা সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারি না। বিজ্ঞানচর্চার ভাষা বিচারে আমাদের গোড়া হলে চলবে না।

উপসংহার:

মাতৃভাষাকে অবহেলা বা বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা — এর কোনোটিই আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে করতে পারিনা ।প্রাথমিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে মাতৃভাষা বাংলা যেমন অপরিহার্য তেমন উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি পর্যায়ের বিজ্ঞানচর্চায় অপরিহার্য ইংরেজি ভাষা। তাই দুটি ভাষাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে সমাজকল্যাণে এগিয়ে যেতে হবে।

সমস্ত রচনা দেখতে: Click Here

Leave a Comment