বাংলা রচনা সমগ্র: বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রবন্ধ রচনা // বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ রচনা
বিশ্ব উষ্ণায়ন
“কত শত সাগর নদী যাবে শুকিয়ে
কত শহরের পরিনতি হবে মরুতে,
উষ্ণায়নের থাবা বাড়তেই থাকবে
সে জ্বালা বুঝবে এ বিশ্ব আগামীতে।”—- ডা. প্রদীপ কুমার রায়
ভূমিকা:
শীতপ্রধান দেশের মানুষ বহু দুপ্রাপ্য এবং ক্রান্তীয় উদ্ভিদ কাঁচের ঘরে অর্থাৎ গ্রীন হাউসে রাখেন। ওই গাছগুলি থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড কাচের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে না পেরে একটি আস্তরণ তৈরি করে, যা সূর্য রশ্মি থেকে প্রাপ্ত তাপের বিকিরণকে বাধা দেয় ফলে এই কাঁচের ঘরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গোটা বিশ্বে আজ মাত্রাছাড়া দূষণ এবং সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত অগ্রগতির ফলে CO2– এর পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তা গ্রিন হাউসে পরিণত হয়েছে, যার উষ্ণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। একেই আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বলে থাকি।
উষ্ণায়নের সূত্রপাত:
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেলজয়ী সুইডিশ বিজ্ঞানী অরথেনিয়াম বায়ুমন্ডলে CO2– এর পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি একে গ্রীনহাউস এফেক্ট নাম দেন। অথচ শীতপ্রধান দেশের ওই কাচের ঘরের মতোই স্বাভাবিক মাত্রার CO2– এর পরিমাণ পৃথিবীর পক্ষে ক্ষতিকর নয়। কারণ এই প্রভাব না থাকলে পৃথিবীর তাপমাত্রা তাপবিকিরণের ফলে সর্বত্র প্রায় 0০c- এ পরিণত হত।
উষ্ণায়নের কারণ:
মানুষের বিলাসবহুল জীবন, শক্তির অপচয়, অরণ্য ধ্বংস, শিল্প বিপ্লব, জ্বালানি খরচ, বাতাসে CO2, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, নাইট্রাস অক্সাইডের মাত্রাবৃদ্ধি সর্বোপরি জলীয় বাষ্প প্রভৃতি গ্রীন হাউস গ্যাসগুলির পরিমাণ এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ফলত বিশ্ব উষ্ণায়ন বর্তমান বিশ্বের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকৃতিতে উষ্ণায়নের প্রভাব:
পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি এইরকম ভাবে বাড়তে থাকে তাহলে ২০৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মেরুপ্রদেশের সমস্ত বরফ গলে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টি, খরা, তাপপ্রবাহ, সুনামি ,তুষারপাত ,ঋতু পরিবর্তনে অসাম্য পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। যেখানে আমাদের কৃষিকাজ বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার অন্যান্য উপাদানের ওপর নির্ভরশীল সেখানে বিশ্ব উষ্ণায়ন কৃষিকাজের ক্ষতিসাধন করে গোটা বিশ্বকে খাদ্যসংকটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।২০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যদি 3⁰সেলসিয়াস বাড়ে সে ক্ষেত্রে কানাডা ও রাশিয়ার বৃহৎ গম উৎপাদন অঞ্চলগুলির গম উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মানবজীবনে উষ্ণায়নের প্রভাব:
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে যে তাপমাত্রার হেরফের বা ঋতুপরিবর্তনের অসাম্য, তা স্বাস্থ্যহানির বড় কারণ। এর ফলে খাদ্য ও জল বাহিত রোগ এবং ম্যালেরিয়া ,ডেঙ্গু, ভাইরাল প্রভৃতি রোগ বৃদ্ধি পাবে। তাপ প্রবাহ যেমন জীবন হানিকর হবে তেমনি তাপমাত্রার দ্রুত হেরফের মানুষের সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গিয়ে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনও ঘটাবে। লুপ্ত হবে বহু কীটপতঙ্গ, প্রাণী- ecological balance- কে নষ্ট করবে।
👉 সমস্ত রচনা দেখতে: Click Here
প্রতিকারের উপায়:
(i) আমরা যদি বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানতে চাই তাহলে শিল্প ও পরিবহন সহ সমস্ত ক্ষেত্রে কয়লা বা খনিজ তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আমাদের কমাতেই হবে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণও আমাদের পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
(ii) আসলে বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে মুক্তি চাইলে আমাদের জোর দিতে হবে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ওপর। পাশাপাশি কার্বন নির্গমন তথা বায়ু দূষণ কম হয় এমন উন্নততর প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো দরকার।
(iii) বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিকারে যেটা সবচেয়ে জরুরি কথা সেটা হলো, গাছপালা বাঁচাতে হবে বনজঙ্গল বাঁচাতে হবে। ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, পৃথিবীকে আবার সবুজে ভরিয়ে তুলতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখতে এগুলো এখন সময়ের জরুরি দাবি।
(iv) শিল্পায়ন ও অরণ্য ধ্বংস বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ হলেও আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা ও এর জন্য দায়ী। এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটার থেকে নির্গত মিথেন, যানবাহন থেকে নির্গত CO2 এই উষ্ণায়নের বড় কারণ। আমাদের বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় রোধ করতে হবে। কারণ যত জ্বালানি খরচ কম হবে, CO2 উৎপাদন কম হবে।
উপসংহার:
উষ্ণায়নের ফলে যেমন মেরু প্রদেশের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়িয়ে দিয়ে প্লাবিত করবে বিশ্বের বহু দেশ তেমনি এর ফলে পৃথিবীর ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ কমে যাবে। সুতরাং বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতি মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে কিয়োটা প্রটোকল- এ CO2 গ্যাস নিঃসরণ চুক্তি হলে উন্নত দেশগুলি তা মেনে নেয়নি। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে এ নিয়ে একটা বিরোধ রয়েছে। যা আদতে ক্ষতি করছে সার্বিক মানব সমাজের। আশা করা যায়, আগামী দিনে মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ নির্ণয়ে এবং তা প্রতিকারে মানব সমাজ অনেক বেশি সচেতন হবে।