Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

First Unit Test2023
দশম শ্রেণী
বিষয়: ইতিহাস
পূর্ণমান: 40 সময়: 90 মিনিট
প্রশ্নমান: ২
১. নতুন সামাজিক ইতিহাস বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ। অতীতে ইতিহাসে শুধুমাত্র রাজা-মহারাজা কিংবা অভিজাতদের কথা লেখা থাকতো। বর্তমানে এই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এখন এখানে সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় সমাজ, এমনকি প্রান্তিক অন্তজদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনের বিবর্তনের কথাও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আধুনিক ইতিহাসচর্চার এই ধারা নতুন সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত।

২. চার্লস উডের ডেসপ্যাচের প্রধান চারটি সুপারিশ লেখো।

উত্তর: শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড ‘শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব’ (Wood’s Education Despatch) নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান । ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে চার্লস উডের সুপারিশ–
(১) শিক্ষার প্রসারের জন্য উডের প্রস্তাব অনুসারে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একজন শিক্ষা অধিকর্তার অধীনে একটি করে শিক্ষাবিভাগ খোলা হয়।
(২) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে অর্থাৎ কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই -এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় । রুরকীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটিও লর্ড ডালহৌসির আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
(৩) সরকারি মডেল স্কুলগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা ।
(৪) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও নারীশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে জোর দেওয়া । ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের চেষ্টায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ।

৩. নব্যবঙ্গ আন্দোলন বলতে কী বোঝো?

উত্তর: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র (১৮০৯-৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী একদল যুবক বাংলার সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে এক আন্দোলনের সূচনা করেন। ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী‘ নামে এবং তাঁদের উদ্যোগে পরিচালিত আন্দোলন ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন‘ নামে পরিচিত।

৪. কোল বিদ্রোহের দুটি কারণ লেখো।

উত্তর: কোল বিদ্রোহের দুটি কারণ হল –
(১) রাজস্ব বৃদ্ধি: জমিদাররা কোলদের ওপর রাজস্বের পরিমান বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
(২) অত্যাচার: কর আদায়ের জন্য বহিরাগতরা কোলদের অনেক অত্যাচার করত। পুরুষদের বন্দি করে রাখা হত এবং বেগার খাটানো হত।

৫. সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর :
সাময়িকপত্র এবং সংবাদপত্রের পার্থক্য হল –

(i) সাময়িকপত্র নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রকাশিত পত্রিকা। কিন্তু সংবাদপত্র দৈনিক বা প্রত্যহ প্রকাশিত পত্রিকা।
(ii) সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয় দামি কাগজে। কিন্তু সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে তুলনামূলক সম্ভা দামের কাগজে।
(iii) সাময়িকপত্র বাঁধাই আকারে থাকে। কিন্তু সংবাদপত্র বাঁধাই আকারে থাকে না। তা বাঁধাইহীন আকারে প্রকাশিত হয়।

৬. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর:
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশিত খবর, সংবাদ বিশ্লেষন এবং সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে, এই পত্রিকার ৫ টি মূল উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরা যায়। এগুলি হল –

(১) ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অনিয়ম ও স্বৈরাচারী দিক গুলিকে তুলে ধরা,
(২) সরকারি শাসন নীতির ক্রুটি বিচ্যুতি গুলি তুলে ধরে তার সমালোচনা করা,
(৩) কৃষকদের ওপর জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচারের স্বরূপ তুলে ধরা,
(৪) নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ, পুরুষের বহু বিবাহ রদ ইত্যাদি প্রগতিশীল সংস্কারের স্বপক্ষে জনমত গঠন করা,
(৫) জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও আদর্শ প্রচার করা।

৭. এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: এশিয়াটিক সোসাইটি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। 1784 সলে কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠা করেন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস।
এর উদ্যেশ্য ছিল-
(১) প্রাচ্যবিদ্য চর্চা
(২) ভারতের অতীত ইতিহাস চর্চা।
এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয়।

৮. সনদ আইনের দুটি গুরুত্ব লেখো।

উত্তর:
1813 সালের সনদ আইন ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। যার ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ পায়।

গুরুত্ব:
(১) সনদ আইনে মিশনারীরা শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। ফলে শিক্ষায় ধর্মীয় বিষয়ের প্রাধান্য পায়, স্বাধীন ভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পুস্তক প্রকাশ, নারী শিক্ষার বিস্তার, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজ শুরু করে।
(২) সনদ আইনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি ভারতের জাতীয় শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কারণ সনদ আইন পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচার এর জন্য ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে সরকারি স্বীকৃতি দেয়।

৯. চুঁইয়ে পড়া নীতি বলতে কী বোঝায়?

উত্তর:
লর্ড বেন্টিং-এর আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৫ সালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব দেন যা ‘মেকলে মিনিটস’ নামে পরিচিত।
এই প্রস্তাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের স্বপক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং তাদের দ্বারা তা চুইয়ে ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে ভারতীয়রা রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় ইংরেজদের মত হয়ে উঠবে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে মেকলের নেওয়া এই নীতি ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ নামে পরিচিত।

১০. মেকলে প্রস্তাব কী?

উত্তর:
লর্ড বেন্টিং-এর আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ‘জনশিক্ষা কমিটি’র সভাপতি নিযুক্ত হন। এসময় এদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত এই প্রশ্নে এই কমিটির সদস্যরা প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী – এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। উগ্র পাশ্চাত্যবাদী মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবী জানিয়ে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লর্ড বেন্টিং-এর কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাব ‘মেকলে মিনিটস’ বা ‘মেকলে প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।

১১. ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর:
রাজা রামমোহন রায় উপনিষদের একেশ্বরবাদী তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল—

(১) এক ও অদ্বিতীয় ব্রত্মের উপাসনা করা।
(২) খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।
(৩) বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
(৪) হিন্দুধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচার প্রচলিত আছে তার উচ্ছেদ করা।

১২. সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর: পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে বাংলায় কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দুটি দিক থেকেই সন্ন্যাসী ও ফকিররা নানা রূপ বাধা ও ক্ষতির সম্মুখীন হন। এর ফলেই মূলত তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৭৬৩ খ্রিঃ থেকে ১৮০০ খ্রিঃ পর্যন্ত টানা ৩৭ বছর সন্ন্যাসী ফকিররা বিদ্রোহ চালিয়ে যান।
গুরুত্ব:
(১) সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিলো ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ।
(২) এই বিদ্রোহে প্রথম ইংরেজ সরকার হিন্দু মুসলিম যৌথ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই বিদ্রোহে সামিল হন এবং নেতৃত্ব দেন।
(৩) সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম সশস্ত্র অভ্যুত্থান। প্রায় ৪০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই বিদ্রোহ চলেছিলো।
(৪) এই বিদ্রোহেই প্রথম গেরিলা রননীতি অনুসৃত হয়।

প্রশ্নমান: ৪
১. টীকা লেখো: বামাবোধিনী পত্রিকা
অথবা বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের নারী সমাজ সম্পর্কে কি জানা যায়?

উত্তর: সূচনা : উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িক পত্র গুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত বামাবোধিনী পত্রিকা। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র দত্ত কয়েকজন তরুণ ব্রাহ্মণ কে নিয়ে বামাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন এই সবার পক্ষ থেকে ওই বছরেই বামাবোধিনী পত্রিকা শুরু হয় এবং দীর্ঘ 60 বছর ধরে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
বামাবোধিনী পত্রিকার গুরুত্ব :

(১) নারী সমাজের অবস্থা: উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলায় নারীদের সামাজিক অবস্থার বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। নারী শিক্ষার বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ সুনজরে দেখতো না। ফলে বাংলায় নারী শিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি।

(২) কুপ্রথার অস্তিত্ব: বামাবোধিনী পত্রিকা উনিশ শতকে নারী সমাজের বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ ,পর্দাপ্রথার প্রভৃতির সামাজিক কুসংস্কার তুলে ধরে এসবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়।

(৩) সম্পত্তির অধিকার হীনতা: অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীরা ছিল পরাধীন। নারীরা মূলত বাড়ির অন্দরমহলে আবদ্ধ ছিল।পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের কোনো সুযোগ ছিল না।বামাবোধিনী পত্রিকা নারীদের সামাজিক অর্থনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের লক্ষ্যে নিয়মিত প্রচার চালায়।

(৪) নারী শিক্ষার দাবি: বামাবোধিনী পত্রিকা নারী শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করে।নারী সুশিক্ষিত হলেই সুগৃহিনী পত্নী ও সুমাতা হওয়া সম্ভব এই যুক্তিতে নারী সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে শুরু করে বামাবোধিনী পত্রিকা।

মূল্যায়ন: নারী সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে বামাবোধিনী পত্রিকা যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে শুধু যে নারীদের উন্নতি হয়েছিল তা নয়, এর ফলে গোটা সমাজেরই অগ্রগতি হয়েছিল। এই পত্রিকাতে ভাষা জ্ঞান,ভূগোল, ইতিহাস ,জীবন বিজ্ঞান ,স্বাস্থ্যরক্ষা ,নীতি ও ধর্ম ,দেশাচার , গৃহ চিকিৎসা ,শিশুপালন, শিল্পকর্ম ,গৃহ কার্য এবং অদ্ভুত বিবরণ প্রকাশিত হতো ।

২. সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল লেখো।

উত্তর: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে ভারতে যে সমস্ত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 1855-56 সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

(১) এই বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয় এবং সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
(২) সাঁওতাল পরগনায় সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয় এবং মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের সাঁওতাল পরগনায় প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।
(৩) সাঁওতালদের অভাব-অভিযোগের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা হয়নি বা সাঁওতালদের জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াও হয়নি।
(৪) সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে ইউরোপিয় খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য বোধ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
(৫) সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক কথা সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগায়, যা পরবর্তীকালে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, “এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিলো এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।
(৬) অনেক ঐতিহাসিকের মতে, 1855 খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, “এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।”কারণ সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি হলেও কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতি সম্প্রদায় কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, এমনকি নারীরাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সবশেষে ঐতিহাসিক কালীকিংকর দত্তের মতানুসারে বলা যায়, “This episode opened a new chapter in the history of Bengal and Bihar.”

৩. ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর:
উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরবি ‘ফরাইজ শব্দ থেকে ফরাজি আন্দোলনের নামকরণ হয়েছে।

লক্ষ্য: ফরাজি আন্দোলনের মূল লক্ষ্যগুলি ছিল—
(১) আদর্শ অনুসরণ : কোরানের পবিত্র আদর্শ অনুসরণ করে চলা, ইসলাম-নির্দিষ্ট কর্তব্য ও পবিত্র বিশ্বাস মেনে চলা এবং ইসলামীয় ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করে তরিকা-ই-মােহম্মদীয়া’ বা মােহম্মদ নির্দেশিত পথে চলাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।

(২) কৃষক-মুক্তি : এই আন্দোলন অত্যাচারী হিন্দু জমিদার, নীলকর ও রক্ষণশীল মুসলমানদের শােষণ থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্ত করতে এবং ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য গড়ে উঠেছিল।

(৩) বৈষম্য দূরীকরণ : এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং জমির ওপর সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক বৈষম্য দূর করা।

(৪) জুম্মা প্রার্থনায় নিষেধ : ফরাজিরা মনে করত ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষ ‘দার-উল হারব’ বা ‘বিধর্মীদের দেশ’ এবং একারণে ভারতে নামাজ বা ইদের সময় জুম্মা প্রার্থনা করা উচিত নয়।

মূল্যায়ন : এভাবে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমেই তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়; কেননা ফরাজি আন্দোলন কখনােই একটি হিন্দু-বিরােধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না।

৪. ইতিহাসের উপাদান হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী জীবনস্মৃতি-র গুরুত্ব লেখো।

উত্তর:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা স্মৃতিকথামূলক একটি গ্রন্থ হল ‘জীবনস্মৃতি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনোই জীবনের ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যে ‘জীবনস্মৃতি’ রচনা করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন এটি তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের মত নয়, এটি তাঁর স্মৃতি রোমান্থন করে লেখা। তাই বলা যায় আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ‘জীবনস্মৃতি’-র গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রকাশকাল ও পত্রিকা: ১৩১৯ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তার আগে এটি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকায় ভাদ্র, ১৩১৮ বংগাব্দ থেকে শ্রাবণ, ১৩১৯ বংগাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ছিল – ‘শিক্ষারম্ভ’, ‘ঘর ও বাহির’, ‘ভৃত্য-রাজকতন্ত্র’, ‘কবিতা রচনারম্ভ’, ‘স্বাদেশিকতা’, বংশতালিকা-সহ ৪৫ টি লেখা। নিন্মে ইতিহাসের উপাদান হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’-র গুরুত্ব আলোচনা করা হল –

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল: ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তথা ঠাকুর পরিবারের শিশুদের ছোটবেলা ও তাদের শিক্ষা লাভ, সংগীত চর্চা প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল -এর বিভিন্ন অবস্থা, নারী-পুরুষের অবস্থা, উৎসব-অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।

বাঙালি সমাজে জাতীয় চেতনার প্রসার: ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে বাঙালি সমাজের জাতীয় চেতনার প্রসারের কথা জানা যায়। এই সময়ে বাঙালি সমাজে স্বদেশী ভাবধারার প্রসার ঘটে। এই সময় বাঙালিরা একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করছে অন্যদিকে তেমনই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও অনুরাগ দেখায়।

বাঙালির স্বাদেশিকতা: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ও রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্বাদেশিকতার বিভিন্ন সভা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য এই গ্রন্থে রয়েছে। নবগোপাল মিত্রের হিন্দু মেলা ও স্বদেশী কাপড়, স্বদেশী দেশলাই ইত্যাদি সম্পর্কে এবং যুব সমাজের উদ্যোগ বিষয়ে বিভিন্ন কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক যোগ: জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লেখক সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণ দেননি। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দেশাত্মবোধক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অংশ নিয়েছেন, যা তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়।

মূল্যায়ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “এই স্মৃতির ভান্ডারে অত্যন্ত যথাযথ রূপে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে”। এই গ্রন্থ থেকে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের বিষয়ে লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাও বলা যায়, আধুনিক ইতিহাস চর্চায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’-র গুরুত্ব অপরিসীম।

৫. ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি কী কী?

উত্তর:
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহারের সুবিধা অনেক।

ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা:

(১) তথ্য সংগ্রহ সহজ : অতি সহজে ঘরে বসে দুনিয়ার প্রায় যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
(২) তথ্য সংগ্রহ দ্রুত হয় : ইঞ্জিনের সাহায্যে প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত খুঁজে বের করা যায়।
(৩) তথ্য সংগ্রহে স্বল্প ব্যয় : প্রচুর অর্থ ব্যয় না করে বই না কিনে অতি সামান্য অর্থের বিনিময় ডাটা ব্যবহার ওরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
(৪) পৃথিবীর বিখ্যাত লাইব্রেরী ব্যবহার : ঘরে বসেই সারা পৃথিবীর অনলাইন লাইব্রেরী থেকে দুষ্প্রাপ্য মূল গ্রন্থ কিংবা রিপোর্ট সংগ্রহ করা যায়।

ইন্টারনেট ব্যবহারের অসুবিধা:

উপরোক্ত সুবিধার সত্বেও ইন্টারনেট ব্যবহারের কিছু অসুবিধাও আছে-
(১) যথার্থতা যাচাই করা কঠিন : ইন্টারনেট থেকে নেওয়া তথ্যগুলি কতটা যথার্থ নির্ভরযোগ্য তা যাচাই করা খুবই কঠিন। কেননা ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা রাখেনা।
(২) বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা : ফলে যে কেউ কোন অসত্য বা মন গড়া তথ্য নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপলোড করে দিতে পারে। ফলে পাঠক বা গবেষক বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
(৩) তথ্য চুরি হওয়ার ভয় : সাম্প্রতিকতম গবেষণার ফলাফল গবেষকের অজান্তে সহজেই অন্যের দ্বারা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
(৪) সাম্প্রতিকতম ও দুর্মূল্য তথ্য সহজলভ্য নয় : চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে কোনো গবেষক সাধারণত সাম্প্রতিক ও দুর্মূল্য গবেষণালব্ধ ফলাফল ওয়েব জগতে প্রকাশ করেন না। ফলের তা সহজলভ্য হয় না।
মূল্যায়ন:
সুতরাং সবকিছুর মত ইন্টারনেট ব্যবস্থারও সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই আছে। তাই অসুবিধার বিষয়ে সচেতন থেকে এই ব্যবস্থার ব্যবহার ইতিহাসচর্চার পক্ষে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে – একথা নিসন্দেহে বলা যায়।

প্রশ্নমান: ৮
১. নীল বিদ্রোহের কারণ কী?

উত্তর:
আঠারো শতকে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব হয়। ফলে সেখানে বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনে নীলের চাহিদা বাড়ে। ১৮৩৩ সালে সনদ আইন এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লুপ্ত হলে কোম্পানির কর্মচারিরা ব্যক্তিগতভাবে নীল চাষে নেমে পড়ে। অধিক মুনাফার আশায় এইসব কর্মচারীরা নীল চাষীদের উপর সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচার শুরু করে। এই শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল চাষিরা হাজার ১৮৫৯ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ নামে খ্যাত।

নীল বিদ্রোহের কারণ–

নীল বিদ্রোহের পিছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ লক্ষ্য করা যায়।

(১) কৃষকের ক্ষতি: নীল চাষের চাষের যে খরচ হতো মিল বিক্রি করে চাষির সে খরচ উঠতো না। ফলে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো।

(২) খাদ্যশস্যের অভাব: নীল চাষ করতে গিয়ে কৃষকেরা খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রয়োজন মতো করতে পারত না। কারণ নীলকর সাহেবরা চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করতেন। ফলে চাষির ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।

(৩) নীলকরদের অত্যাচার : চাষিরা নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকর সাহেবরা তাদের উপর নির্মম অত্যাচার। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া সহ বাড়ি়ির মহিলাদের সম্মানহানি করতেও ইংরেজরা পিছপা হতো না।

(৪) দাদন প্রথা: দাদন বা রায়তি প্রথায় চাষীদের নীলকররা দাদন নিতে বাধ্যয করতো। একবার দাদন নিলে নীল চাষিরা নীলকরদের দাসে পরিণত যেত।

(৫) পঞ্চম আইন এর কুফল: ১৮৩০ সালে রেগুলেশন ফাইভ বা পঞ্চম আইন পাস হয়। এই আইনের বলে নীলকরা চাষীদের দাদন দিয়ে নীল চাষ করতে বাধ্য করতে পারতো। ফলে চাষিরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো।

(৬) দস্তুরি বা ঘুষ প্রথা: নীলকরদের কর্মচারীরাও বিভিন্নভাবে শোষন করতো। অধিকাংশ সময় তারা চাষীদের কাছ থেকে দস্তুরি বা ঘুষ আদায় করত। ফলে চাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো।

(৭) পক্ষপাতমূলক বিচার ব্যবস্থা: ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থা ছিল পক্ষপাত দুষ্ট। নীলকরদেের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে চাষীরা কখনোই ন্যায় বিচার পেতেন না।

(৮) সরকারের উদাসীনতা: চাষীরা নীলকরদের বিরুদ্ধে অথবা বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বের জন্য সরকারের কাছে অভিযোগ জানালেও সরকার তার প্রতিকার করত না।

এই সমস্ত কারণে নীল চাষিরা নীলকর সাহেবদের এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ১৮৫৯ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

২. নীলবিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব লেখ।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য :

নীল বিদ্রোহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

(১) ব্যাপকতা: ব্যাপকতার দিক থেকে এই বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য ছিল। নদীয়া বারাসাত মালদহ ফরিদপুর যশোহর খুলনাসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

(২) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: ওয়াহাবি ফারাজি সাঁওতাল মুন্ডা প্রভৃতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়।

(৩) কৃষক- জমিদার ঐক্য: নীল বিদ্রোহ এমন এক বিদ্রোহ যেখানে কৃষক ও জমিদার শ্রেণি ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহের সামিল হয়, যা সাধারণত দেখাা যায়। নড়াইলের রামরতন রায়, রানাঘাটের শ্রী গোপাল পাল চৌধুরী প্রমূখ জমিদার এই বিদ্রোহ কৃষকদের সঙ্গে যোগদান করেন।

(৪) মধ্যবিত্তের সমর্থন: উনিশ শতকে বাংলার বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ গুলির মধ্যে একমাত্র নীল বিদ্রোহীই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেছিল।

(৫) সংবাদপত্রের সমর্থন: হিন্দু প্যাট্রিয়ট বামাবোধিনী গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সমাচার দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকাগুলি নীল বিদ্রোহের সমর্থনে প্রচার চালিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

(৬) মিশনারিদের সমর্থন: নীল বিদ্রোহে কিছু খ্রিষ্টান মিশনারি সমর্থন করেছিল। ধর্মযাজক জেমস লং নীলদর্পণ নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে এই বিদ্রোহকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছিলেন।

নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব:

এই বিদ্রোহের ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

(১) নীল কমিশন গঠন: বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন করতে বাধ্য হন।

(২) অষ্টম আইন প্রচলন: সরকার ১৮৬৮ সালে অষ্টম অস্টম আইনের দ্বারা পঞ্চম আইন বা নীলচুক্তি আইন বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এতে বলাা হয় এতে বলা হয় নীল চাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন।

(৩) জাতীয়তাবাদপ্রসার: নীল বিদ্রোহের সাফল্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ সহায়ক হয়েছিল। শিশির কুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘ নীল বিদ্রোহ ই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল।

(৪) চা শিল্পে বিনিয়োগ: নীল বিদ্রোহ সফল হওয়ায় নীল করা নীল চাষে অর্থ বিনিয়োগ বন্ধধ করে দেয়। এই অর্থ তারা বিহার ও পার্বত্য এলাকায় চা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করে।

(৫) বাঙালির মনোবল বৃদ্ধি: সর্বোপরি, নীল বিদ্রোহ ছিল বাঙালির সফল ও সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন। এই আন্দোলনে জয়লাভ করার ফলে বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছিল।

৩. সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা লেখো।

উত্তর: উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখেগেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ‘ভারত পথিক’ রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায় সমাজের কুসংস্কার দূর করে আধুনিক সমাজ গঠনে প্রথম সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, রামমোহন রায় ছিলেন সমকালীন বিশ্বের সেই ব্যক্তি যিনি আধুনিক যুগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।

সমাজ সংস্কার:

(১) সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন: সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে অমানবিক সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা-সহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে রামমোহন এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। তার এই প্রচেষ্টার ফলে শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষনা করেন।

(২) নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা: রাজা রামমোহন রায় নারীদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আন্দোলন করেন কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না।

(৩) বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন: রামমোহন বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে তা দেখিয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহুবিবাহের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোন স্ত্রী ব্যাভিচারিণী, সুরাসক্ত ও বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত।

(৪) কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: রামমোহন কৌলীন্য প্রথাবিরোধী ছিলেন। কারণ এই কৌলীন্য প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।

এছাড়াও রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, তা 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার পরমব্রহ্মের উপাসনা করা।তিনি এখানেই থেমে যাননি;শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতেও রামমোহন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাবিস্তার ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের চেষ্টা।

মূল্যায়ন: এভাবে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য— যা নবজাগরণের মূল কথা, তা রামমোহনের কার্যকলাপে লক্ষ করা যায়। তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য তাকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলা হয়।

৪. সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা লেখো।

উত্তর: উনিশ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী সমাজ সংস্কারক। নারীশিক্ষা প্রসার তথা নারীমুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রগামী ।

বিধবা বিবাহ: হিন্দু-সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত নারী সমাজের মুক্তির জন্য বিদ্যাসাগর আজীবন লড়াই করেন। সে যুগে হিন্দু সমাজে বাল্য বিবাহের চল ছিল। কন্যাদায় গ্রস্ত পিতারা সমাজের ভয়ে তাদের কমবয়সি মেয়েদের বয়স্ক লোকেদের সঙ্গে বিবাহ দিতেন। তাই অনেক সময় অল্প বয়সেই এই সমস্ত মেয়েরা বিধবা হত। এর ফলে তাদের দুর্দশার শেষ থাকত না।

নারীজাতির এই করুণ অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করে।হিন্দু শাস্ত্র ও পরাশর সংহিতা’ অধ্যয়ন করে বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে জনমত গঠনের কাজে তিনি মন দেন। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগরের পক্ষে দাঁড়ায় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ১৫নং বিধি দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন বলবৎ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে অষ্টাদশী এক বিধবার বিবাহ দেন। এরকম তিনি ৬০টি বিবাহ দেন।

বাল্যবিবাহ: হিন্দুধর্মে মেয়েদের বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি দূর করার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেন। তিন ‘সর্ব শুভকরী’ পত্রিকায় বাল্য বিবাহের দোষ’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশ করে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। এ ব্যাপারে তিনি সফলও হন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার আইন করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর ধার্য করে।

বহুবিবাহ: সে যুগে হিন্দুসমাজে পুরুষের বহু বিবাহ করার অধিকার ছিল। ফলে কুলিন সমাজে এই প্রথার বহুল প্রচলন ছিল।বিদ্যাসাগর এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হন এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার’ নামক একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু বহুবিবাহ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ সাফল্য পাননি।

অন্যান্য পদক্ষেপ: এ ছাড়া বিদ্যাসাগর মহাশয় সে যুগের কৌলিন্য প্রথা, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন প্রথা, জাতিভেদ প্রথা, ও কুষ্ঠরোগী হত্যা প্রভৃতি নানাবিধ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর উদ্যোগেই খ্যাতনামা চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার বৈদ্যনাথ রাজকুমারী কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

মূল্যায়ন: উনিশ শতকে বাংলার অচলায়তন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার যে-সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছেন তা অভূতপূর্ব। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নির্ভীক সমাজ সংস্কারক সম্পর্কে বলেছেন, এই ভীরুর দেশে তিনিই একমাত্র পুরুষ সিংহ। ড. অমলেশ ত্রিপাঠির মতে তিনি ছিলেন একজন ‘ট্রাডিশনাল মর্ডানাইজার’। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন এমন এক মানুষ—“যার মনীষা প্রাচীন ঋষির মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজের মতো এবং হৃদয়বত্তা বঙ্গজননীর মতো।”

👉 সমস্ত বিষয়ের ইউনিট টেস্টের প্রশ্নপত্র : Click Here
👉 আমাদের YouTube চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করো: Click Here

Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

Class 10 First Unit Test History Question Paper Class 10 First Unit Test History Suggestion Class 10 Second Unit Test History Question Paper Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

WBBSE Class 10 Model Question Paper Unit Test Question Paper History Class X History First Unit Test Question Paper pdf Download Madhyamik History Suggestion Class-10 History First Unit Test Suggestion Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

Official Website: Click Here

দশম শ্রেণীর প্রথম ইউনিট টেস্টের ইতিহাস বিষয়ের প্রশ্নপত্র

Class-10 History First-Unit-Test Question-2023 Class-10 History First-Unit-Test Question-2023

মাধ্যমিক প্রথম পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন ইতিহাস সাজেশন

দশম শ্রেণী প্রথম পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন ২০২৩ ইতিহাস সাজেশন

Leave a Comment