ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা আলোচনা করো।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্সে বুরবো রাজাদের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অসন্তোষ তৈরি হয় তাকে কাজে লাগিয়ে ভলতেয়ার, মন্তেস্কু, রুশো, দিদেরো প্রমুখ ফরাসি দার্শনিকরা জনসাধারণের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফরাসি দার্শনিকরা তাঁদের রচনার দ্বারা ফরাসি জনসাধারণকে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলেন।

মন্তেস্কু:

মন্তেসকু ছিলেন ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সমর্থক। তিনি তাহার বিখ্যাত ‘স্পিরিট অব ল’ নামক গ্রন্থে রাজার ভগবান-প্রদত্ত ক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে শাসনতন্ত্র এ আইন, শাসন ও বিচারবিভাগকে পৃথক রাখার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। তাহার রচনা পাঠ করে শিক্ষিত ফরাসী জনসাধারণ নিয়মতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন।

ভলতেয়ার:

একাধারে দার্শনিক, ঐতিহাসিক, কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক ভলতেয়ার (প্রকৃত নাম ফাঁসােয়া মারি আরােয়েৎ) ছিলেন সেসময়কার ফ্রান্স তথা ইউরােপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। তিনিই প্রথম বলেন যে—ইতিহাস শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের কাহিনি নয়, এতে সভ্যতা ও সমাজ বিবর্তনের পরিচয় মেলে। অতীতের আলােকে বর্তমানকে যাচাইয়ের হাতিয়ার ইতিহাস। তিনি স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবাদের বিচারে সবকিছু গ্রহণ করতে বলতেন। প্রাশিয়া রাজ ফ্রেডারিক-দি-গ্রেট-এর এই সম্মানীয় অতিথিটি এবং রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিনের পরিচিত ভলতেয়ার চেয়েছিলেন চার্চ বা গির্জার প্রতি মানুষের অন্ধ ধর্মবিশ্বাসে ফাটল ধরাতে। তিনি কাঁদিদ’ ও ‘লেতর ফিলজফিক’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই দুটি গ্রন্থে তিনি অন্ধ ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। ভলতেয়ার বলেন—লুথার বা কেলভিন অপেক্ষা আমার যুগে আমি কম করিনি।

রুশাে:

অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৈপ্লবিক ছিলেন রুশো। তাকে ফরাসি বিপ্লবের জনক’ বলা হয়। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল— সামাজিক চুক্তি’ (Social Contract) এবং ‘অসাম্যের সূত্রপাত (Origin of Inequality)।‘ সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থে রুশো বলেন যে, মানুষের মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করবে। তার মতে, জনগণই হল রাষ্ট্রীয় শক্তির উৎস এবং তারাই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী চুক্তির মাধ্যমে রাজা শাসনক্ষমতা লাভ করেন। ‘অসাম্যের সূত্রপাত’ গ্রন্থে তিনি বলেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মায়। কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা তাকে দরিদ্র ও পরাধীন করে। এককথায় স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে রুশো সকল জনগণের সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলেছেন।

দেনিস দিদেরো ও দ্য এলেমবার্ট:

ফরাসি দার্শনিকদের প্রথম সারিতেই ছিলেন দেনিস দিদেরাে। একাধারে দার্শনিক, শিল্পী, সমালােচক, লেখক দেনিস দিদেরাে দ্য এলেমবার্টের সাহায্যে ৩৫ খণ্ডের (১৭৫১ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) বিশ্বকোশ সংকলন করেন। অঙ্ক, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল বিশ্বকোশ। দিদেরাে বলতেন—মানুষ তার জৈবিক সংগঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাঁর মতে – চারপাশের পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের সহজাত। এই ক্ষমতাই মানুষকে মনুষ্যত্ব দিয়েছে, অন্য সমস্ত জীবের থেকে আলাদা করেছে।

মাবলি ও মরেলির অবদান:

মাবলির ‘দে লা লেজিসলেশন’ ও মরেলি রচিত ‘কোড দে লা নেচার ‘ – এই দুটি গ্রন্থে সম্পত্তির যৌথ মালিকানা বা উত্তরাধিকারের অবসানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। মরেলি ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার বিলােপ ও দুঃস্থদের সরকারি সাহায্য দানের কথা বলেছেন। মাবলির মতে, আদিম সমাজ সুখী ছিল কারণ সেই সমাজে সাম্য ছিল। সাম্য ও সম্পত্তির সামাজিকীকরণ প্রজাসাধারণের সুখের এক অন্যতম শর্ত।

ফিজিওক্রাটস গােষ্ঠীর অবদান:

এই যুগে ফিজিওক্রাট নামে একদল অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থ্যার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। ফলে ফ্রান্সের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব সঞ্চারিত হয়ে ছিল।

দার্শনিকদের অবদানের মূল্যায়ন:

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান আদৌ ছিল কি না বা থাকলেও কতটা ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিক বা গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।

পক্ষে যুক্তি :

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদানকে স্বীকার করে নিয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন—তেইন, রুস্তান, সেতেব্রিয়া, তকভিল, মাদেলা, রুদে, হল্যান্ড রােজ, বারনেভ প্রমুখ। এঁদের যুক্তি ছিল—
[i] দার্শনিকেরা সেসময়কার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে বিচার করে অন্যায়, অবিচার ও অনাচারগুলিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।
[ii] দার্শনিকরা শিক্ষাদর্শ, উদারনৈতিক মতবাদ ও ন্যায়নীতি তুলে ধরে জনগণের মনে বিপ্লব সম্পর্কে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
[iii] সমকালীন ইউরােপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক অসাম্য থাকলেও সেখানে বিপ্লব ঘটেনি দার্শনিকদের অভাবের জন্য, কিন্তু ফ্রান্সে দার্শনিকদের জন্যই বিপ্লব ঘটে।

এরই পরােক্ষ প্রভাবস্বরূপ সর্বসাধারণের মনে বিপ্লবের প্রেরণা এসেছিল। ফরাসিবাসীদের ওপর দার্শনিকদের প্রভাব প্রসঙ্গে তেইন বলেছেন—ফ্রান্স দর্শনের বিষ পান করেছিল (“France drank the poison of philosophy”) .

বিপক্ষে যুক্তি:

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের কোনােরকম প্রভাব ছিল না বলে মনে করেন জোরেস ম্যালে দু-পা, মিশলে, নােফেভর, মাতিয়ে, মিগনে, লাবুস, থিয়ার্স, গুডউইন, মর্সস্টিফেনস, কোব্যান প্রমুখ। এঁদের যুক্তি ছিল—
[i] দার্শনিকরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে পুরাতনতন্ত্রের সমালােচনা করলেও সরাসরি বিপ্লবের ডাক দেননি বা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেননি। তাই বিপ্লবে তাঁদের কোনাে প্রভাব ছিল না।
[ii] ফরাসি বিপ্লব ঘটার ক্ষেত্রে দার্শনিকদের কোনাে অবদানই ছিল না। কেননা তারা লেখনী ধারণ করার অনেক আগেই বিপ্লবী ভাবধারার সঙ্গে ফরাসিবাসী পরিচিত ছিল।
[iii] দার্শনিকরা নন, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল।
[iv] দার্শনিকদের আদর্শগত কোনাে মিল ছিল না। রুশাের আদর্শ ছিল প্রজাতন্ত্র ও সাম্য, মন্তেস্কুর আদর্শ ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, ভলতেয়ারের জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার, ফিজিওক্রাটসদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিরােধিতা ইত্যাদিতে বিপ্লবের কোনাে আহ্বান ছিল না।

উপসংহার:

ফরাসী বিপ্লবের আগমনে দার্শনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায়। টেইন, সেতোব্রিয়া প্রমুখ ঐতিহাসিক গণ দার্শনিকদের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে দার্শনিকগণ ফরাসী বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। ঐতিহাসিক উইলার্ট মন্তব্য করেছেন যে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ফলে মানুষের আশা-আকাঙ্খা অনুচ্চারিত, অব্যক্ত হয়ে মনের মধ্যে গুমরে উঠেছিল।

_____________0_____________

👉 ইউনিট টেস্টের প্রশ্নপত্র : Click Here
👉 আমাদের YouTube চ্যানেল: Click Here

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা কি ছিল? | ফরাসি বিপ্লবে সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের অবদান কি ছিল? |ইউরোপের ইতিহাস , ফরাসি বিপ্লব| ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস আলোচনা করো। নবম শ্রেণীর ইতিহাস ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস রুশো, মন্তেস্কু, ও ভলতেয়ারের ভূমিকা আলোচনা করো।

CLOSE