প্রশ্ন: নরমপন্থী বলতে কী বোঝায়? নরমপন্থীদের দাবি কী ছিল? তাদের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো।
ভূমিকা:
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময়, কংগ্রেসের আদিপর্বের নেতারা নরমপন্থী বা মডারেট নামে পরিচিত ছিলেন। এরা আবেদন-নিবেদন নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতীয়দের দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। তাদের এই শান্তিপূর্ণ নীতির কারণে তারা নরমপন্থী নামে পরিচিত হন।
নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ:
নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দাদাভাই নৌরজি, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, বদরুদ্দিন তায়েবজি, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, ঊমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
* নরমপন্থী বলার কারণ:
(1) এই সময়ের কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন না।
(2) তারা ব্রিটিশ শাসনের ন্যায়বিচার এবং সাংবিধানিক পদ্ধতির প্রতি আস্থা রাখতেন।
(3) পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডার তাদের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস ছিল।
(4) ইংরেজ শাসনকে তারা ভারতীয় সমাজের উন্নতির জন্য উপযোগী মনে করতেন।
(5) তারা ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদের বদলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের চেষ্টা করতেন।
সরকারের কাছে নরমপন্থীদের দাবি:
(1) জাতীয় চেতনার সঞ্চার: বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে একত্রিত করে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।
(2) সংহতি গঠন: কংগ্রেস বিভিন্ন শহরে অধিবেশন আয়োজন করে জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করে।
(3) আবেদন-নিবেদন নীতি: ব্রিটিশ সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি পেশ করা।
(4) তিনটি অহিংস নীতি: “Prayer, Please, Petition” নীতির মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা।
(5) সরকারি নীতির সমালোচনা: ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় নীতিগুলির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ।
সীমাবদ্ধতা:
(1) সাংগঠনিক দুর্বলতা: তারা আবেদন করলেও তা বাস্তবায়নের মতো যথেষ্ট শক্তি ছিল না।
(2) জনগণের কাছে অপ্রাসঙ্গিক: তাদের কর্মসূচি মূলত উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য ছিল। কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি তারা নিতে ব্যর্থ হন।
(3) রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি: তাদের নীতিকে “রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি” বলে সমালোচিত হতে হয়।
(4) কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব: তাদের শান্তিপূর্ণ নীতির কারণে কংগ্রেসে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
উপসংহার:
নরমপন্থীরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন। যদিও তাদের সীমাবদ্ধতা ছিল, তারা সারা দেশে জাতীয় চেতনার সঞ্চার ঘটান এবং রাজনৈতিক ঐক্যের একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করেন। তাদের কাজের ধারাবাহিকতায়ই পরবর্তী সময়ে উগ্রপন্থীরা আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলেন।
আরও পড়ুন: কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর:
১) জাতীয় কংগ্রেস কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
= ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে।
২) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা কে?
= অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম।
৩) জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
= বোম্বাইয়ের গোকুল দাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে।
৪) জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি কে ছিলেন?
= উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী।
৫) জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের ভাইসরয় কে ছিলেন?
= লর্ড ডাফরিন।
৬) জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মুসলিম সভাপতি কে?
= বদরুদ্দিন তৈয়াবজী।
৭) জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি কে ছিলেন?
= অ্যানি বেসান্ত।
৮) জাতীয় কংগ্রেসের কোন অধিবেশনে “বন্দেমাতরম” গানটি গাওয়া হয়?
= ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতা অধিবেশনে।
৯) জাতীয় কংগ্রেসের কোন অধিবেশনে চরমপন্থী ও নরমপন্থী বিভাজন ঘটে?
= ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে, সুরাট অধিবেশনে।
চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের পরিচয় ও লক্ষ্য
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল— চরমপন্থী এবং নরমপন্থী। তাদের নীতিগত পার্থক্যের কারণে তারা স্বাধীনতার জন্য আলাদা পথ অনুসরণ করেছিল।
চরমপন্থী:
চরমপন্থীরা ধৈর্য ও আবেদন-নিবেদনের নীতি থেকে আস্থা হারিয়ে শক্তিশালী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ গড়ে তুলে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন।
চরমপন্থীদের লক্ষ্য:
- পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন: ব্রিটিশদের পুরোপুরি ভারত থেকে বিতাড়িত করা।
- স্বদেশি আন্দোলন: দেশীয় পণ্য ব্যবহারের প্রচলন।
- বয়কট আন্দোলন: ব্রিটিশ পণ্য ও পরিষেবার বর্জন।
- আত্মত্যাগ ও সংগ্রামে বিশ্বাস: আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা।
চরমপন্থী নেতারা:
- বাল গঙ্গাধর তিলক
- বিপিন চন্দ্র পাল
- লালা লাজপত রায়
তাদেরকে “লাল-বাল-पाल” ত্রয়ী বলা হয়।
চরমপন্থীদের সফলতা:
- প্রথমবারের মতো স্বরাজকে ভারতবাসীর জন্মগত অধিকার বলে দাবি করেন।
- জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটান।
- জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেন।
- স্বাধীনতার জন্য সরাসরি আন্দোলনের পথ দেখান।
নরমপন্থী:
নরমপন্থীরা বিশ্বাস করতেন যে ধৈর্য, আবেদন-নিবেদন এবং আলোচনার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব।
নরমপন্থীদের লক্ষ্য:
- ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার বিকাশ।
- ধাপে ধাপে স্বরাজ লাভ করা।
- প্রশাসনে ভারতীয়দের অধিকার বৃদ্ধি।
- ন্যায়ব্যবস্থাকে শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক করা।
- স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উন্নয়ন।
নরমপন্থী নেতারা:
- দাদাভাই নওরোজি
- গোখলে
- ফিরোজশাহ মেহতা
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
নরমপন্থীদের সফলতা:
- জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা।
- প্রাথমিক রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের চেষ্টা।
- জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি তৈরি।
উপসংহার:
চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের লক্ষ্য এক হলেও তাদের কর্মপদ্ধতি ভিন্ন ছিল। নরমপন্থীরা ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে চরমপন্থীরা সরাসরি আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। তবে উভয়ের অবদান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলে।
কিছু MCQ প্রশ্ন উত্তর
১) চরমপন্থীরা কোন লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন?
(A) ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভ
(B) সরাসরি আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা
(C) ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতা
(D) কেবল শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন
উত্তর: (B) সরাসরি আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা
২) নরমপন্থীদের মূল লক্ষ্য কী ছিল?
(A) শক্তিশালী আন্দোলন
(B) পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন
(C) ধাপে ধাপে স্বরাজ লাভ
(D) ব্রিটিশ শাসনের তাত্ক্ষণিক পতন
উত্তর: (C) ধাপে ধাপে স্বরাজ লাভ
৩) ‘স্বদেশি’ আন্দোলনের ধারণা কারা প্রচলন করেছিলেন?
(A) চরমপন্থী
(B) নরমপন্থী
(C) ব্রিটিশ সরকার
(D) সমাজ সংস্কারকরা
উত্তর: (A) চরমপন্থী
৪) চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে কে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না?
(A) বাল গঙ্গাধর তিলক
(B) বিপিন চন্দ্র পাল
(C) গোখলে
(D) লালা লাজপত রায়
উত্তর: (C) গোখলে
৫) নরমপন্থীদের প্রধান নেতা কে ছিলেন?
(A) দাদাভাই নওরোজি
(B) বিপিন চন্দ্র পাল
(C) লালা লাজপত রায়
(D) বাল গঙ্গাধর তিলক
উত্তর: (A) দাদাভাই নওরোজি
৬) চরমপন্থীরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোন কৌশল গ্রহণ করেছিলেন?
(A) আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়
(B) আবেদন-নিবেদন
(C) বয়কট এবং প্রতিবাদ
(D) ব্রিটিশদের সাহায্য
উত্তর: (C) বয়কট এবং প্রতিবাদ
৭) ‘স্বরাজ’ শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেন?
(A) দাদাভাই নওরোজি
(B) মহাত্মা গান্ধী
(C) বাল গঙ্গাধর তিলক
(D) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
উত্তর: (C) বাল গঙ্গাধর তিলক
৮) নরমপন্থীরা ব্রিটিশ শাসনের কোন বিষয়ে বিশ্বাস করতেন?
(A) ব্রিটিশরা ভারতের উন্নয়ন করবে
(B) শক্তিশালী আন্দোলনের প্রয়োজন
(C) আলোচনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে পরিবর্তন
(D) ব্রিটিশদের সম্পূর্ণভাবে ভারত ত্যাগ করা
উত্তর: (C) আলোচনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে পরিবর্তন
৯) চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে কোন বছরে বিভাজন ঘটে?
(A) ১৮৯০
(B) ১৯০৫
(C) ১৯০৭
(D) ১৯১০
উত্তর: (C) ১৯০৭
১০) ‘লাল-বাল-পাত’ ত্রয়ী কারা ছিলেন?
(A) দাদাভাই নওরোজি, গোখলে, ফিরোজশাহ মেহতা
(B) বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন চন্দ্র পাল
(C) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোখলে, বাল গঙ্গাধর তিলক
(D) মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল
উত্তর: (B) বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন চন্দ্র পাল