প্রশ্ন ১: ‘সরকারি নথিপত্র’ বলতে কী বোঝায়?
(i) ‘সরকারি নথিপত্র’ বলতে বোঝায় (অ) পুলিশ বিভাগের রিপোর্ট ও জরুরি চিঠিপত্র, (আ) গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট ও বিভিন্ন তথ্য এবং (ই) সরকারি আধিকারিকদের লেখা গোপন ও প্রকাশ্য চিঠিপত্র, প্রতিবেদন, বিবরণ, সমীক্ষা, নোটিশ প্রভৃতি।
(ii) এইসব নথিপত্র থেকে সরকারের মনোভাব, পদক্ষেপ, উদ্যোগ প্রভৃতি জানার পাশাপাশি ওই নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে তথ্য, যেমন হান্টার কমিশনের রিপোর্ট থেকে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়, নীল কমিশনের রিপোর্ট থেকে কৃষক বিদ্রোহের কথা পাওয়া যায়।
(iii) সরকারি নথিপত্রগুলি সরকারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয় বলে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষিত থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত তথ্যের উপস্থাপনা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন ২: নিম্নবর্গের ইতিহাস বলতে কী বোঝো?
1980-এর দশক থেকে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন গবেষকের উদ্যোগে জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম প্রভৃতি নির্বিশেষে নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষকে নিয়ে ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা বা সাবলটার্ন স্টাডিজ নামে পরিচিত।
নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ঐতিহাসিক হলেন—রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শাহিদ আমিন, সুমিত সরকার, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র প্রমুখ।
প্রশ্ন ৩: কাদম্বিনী (বসু) গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণীয় কেন:
বেথুন কলেজের ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ছিলেন বহরমপুর কলিজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা। পরবর্তীকালে তিনি দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কাদম্বিনী বসু বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম। কারণ—
প্রথমত, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন কাদম্বিনী বসু। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট হন কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসু।
দ্বিতীয়ত, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক ছিলেন কাদম্বিনী বসু।
তৃতীয়ত, বাংলার চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা।
প্রশ্ন ৪: বিপ্লব বলতে কী বোঝায়?
বিপ্লব (Revolution): বিপ্লব বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত ও কার্যকরী পরিবর্তন। যখন কোনো দেশে পুরাতনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্র, এমনকি চিন্তার জগতে ব্যাপক ও সর্বাত্মক পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে ‘বিপ্লব’ বলা হয়।
উদাহরণ: ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব, যা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।
প্রশ্ন ৫: বে-এলাকা চাষ কাকে বলে:
বে-এলাকা চাষ হলো নীল চাষের একটি পদ্ধতি, যেখানে নীলকরদের নিজস্ব জমি না থাকলেও তারা কৃষকদের জমি ইজারা নিয়ে বা দাদনের মাধ্যমে চাষ করাত।
বৈশিষ্ট্য:
- নীলকররা কৃষকদের অগ্রিম টাকা (দাদন) দিতেন এবং সেই শর্তে কৃষকদের জমিতে নীল চাষ করাতে বাধ্য করতেন।
- কৃষকদের জমিতে নীল চাষ করানো হলেও তারা ন্যায্য মূল্য পেত না।
- এই পদ্ধতিতে কৃষকদের উপর অত্যাচার ও শোষণ চরমে পৌঁছাত।
এই পদ্ধতি কৃষকদের জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল এবং এটি নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
প্রশ্ন ৬: টীকা লেখো: নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন
নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝানো হয় নাটক বা নাট্যচর্চার উপর রাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তির দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ বা ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে সরকার বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষ নাটক, মঞ্চ পরিবেশনা, এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের বিষয়বস্তু ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে থাকে। এটি সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য, বিশেষ করে বিরোধী ভাবনা বা আন্দোলন দমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
নাট্যাভিনয়ে জাতীয়তাবাদী ভাবনা
সাহিত্য ও সংবাদপত্রে উগ্রতাবাদী বিরোধী ও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রকাশ সরকারি মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। এই সময়ে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী নাটক প্রকাশ্যভাবে অভিনীত হতে থাকে, এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। বিশেষভাবে দীনবন্ধু মিত্রের রচিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিল, যা ব্রিটিশ শাসনবিরোধী এক শক্তিশালী বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
১৮৭০ সালের পর চা বাগানের কর্মচারীদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে অমিত লাল বসুর “চাকর দর্পণ” নাটকটি অভিনয় শিল্পের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গভীর অনুভূতি এবং প্রতিবাদ সঞ্চার করে। এ সময় ‘সুনন্দ বিনোদিনী’ নামে এক নাটকের দৃশ্যে এক ইংরেজকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা নাট্যদৃশ্যে দেখানো হয়, যা ইংরেজ শাসকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। এসব নাটক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করে।
প্রশ্ন ৭: অস্ত্র আইন কী?
ইংরেজ শাসন-শোষণ ও পীড়নে ভারতবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে ব্রিটিশ শাসক লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে একটি আইন পাশ করেন, যা অস্ত্র আইন নামে পরিচিত। এই আইনের অধীনে বলা হয়েছিল, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ভারতীয় ব্যক্তি আগ্নেয় অস্ত্র বহন বা রাখার অধিকার রাখবে না।
এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনগণের অস্ত্রধারণের ক্ষমতা সীমিত করে ব্রিটিশ শাসনকে আরও শক্তিশালী করা এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ দমন করা।
প্রশ্ন ৮: বাংলার মুদ্রণ শিল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা লেখো।
অথবা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী স্মরণীয় কেন?
(1) ভূমিকা
বাংলা তথা ভারতের মুদ্রণ জগতে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বাঙালি ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এর নামকরণ হয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপার বিষয় নিয়ে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে মুদ্রণ শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
(2) প্রধান অবদানসমূহ
হাফটোন ব্লক আবিষ্কার:
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তার ছাপাখানায় কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে অক্ষর বা ছবি খোদাই করে মুদ্রণের জন্য ব্লক তৈরি করেন। অন্ধকার ঘরে বসে আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলন লক্ষ্য করে তিনি হাফটোন ব্লক আবিষ্কার করেন, যা মুদ্রণ শিল্পে বিপ্লব নিয়ে আসে।
রঙিন ছবির ব্যবহার:
বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভিতরের পাতায় বিভিন্ন ছবি ব্যবহার করার জন্য তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। রঙিন মুদ্রণের জন্য উপেন্দ্রকিশোর নানা ডায়াফ্রাম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডুয়োটাইপ প্রভৃতি আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে রঙিন ছবির ব্যবহার সম্ভব হয়।
স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা:
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপাখানার সঙ্গে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর পরিকাঠামো উন্নত করতে তার পুত্র সুকুমার রায়কে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান।
বই ও পত্রিকা প্রকাশ:
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তার ছাপাখানার মাধ্যমে ছোটদের জন্য বিভিন্ন রংবেরঙের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন, যেমন ‘টুনটুনির বই’, ‘গুপি গাইন বাঘাবাইন’, ‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছেলেদের মহাভারত’ ইত্যাদি। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাদাকালো ছবির সঙ্গে এশিয়ার প্রথম রঙিন ছবি দিয়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।
উপসংহার
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপাখানা বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার অনুপ্রেরণায় বাংলা মুদ্রণ শিল্পে নতুন যুগের সূচনা হয় এবং তার এই অবদান আমাদের বর্তমান মুদ্রণ শিল্পে প্রতিফলিত হয়। তাই, ভারতে ছাপাখানার পথপ্রদর্শক রূপে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে স্মরণ করা হয়।
প্রশ্ন ৯: তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলি কী?
তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলি ছিল:
- ফসলের তিনভাগের একভাগ কৃষকদের দাবি: জমির মালিকদের কাছ থেকে কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের একভাগ পাওনা দাবি করতেন।
- দাদন প্রথার অবসান: কৃষকদের উপর ঋণের বোঝা কমানোর জন্য দাদন প্রথা বাতিলের দাবি ছিল।
- কৃষকদের মর্যাদা ও অধিকার: কৃষকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।
- জমির মালিকদের নির্দিষ্ট অংশ: কৃষকদের জীবিকার জন্য জমির মালিকদের থেকে নির্দিষ্ট অংশ দাবি করা।
এই আন্দোলন ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে বাংলার কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়েছিল।
আরও পড়ো: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্তর